কার্টেসিঃ নিবারণ বড়ুয়া: সাংবাদিক, কলামিস্ট।
সাবেক বিলছড়ি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মারমা সম্প্রদায়ের একটি গ্রামের নাম। লামা উপজেলায় দুই মারমা পাড়া নিয়েই এই গ্রাম। তবে ৮০ দশকের পরে সেখানে বেশ কিছু এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে মুসলিম সম্প্রদায়ের বসতি। ধর্ম আর ভাষার ভিন্নতা থাকলেও দুই সম্প্রদায়ের মাঝে রয়েছে মনের মিলও বেশ। পাড়া প্রতিবেশী হিসেবে জীবনযাপনের মধ্যেই তাদের দিন অতিবাহিত হয়। নিজের প্রয়োজনে বা পরিবারের প্রয়োজনে একজন ছুটে যায় অন্যজনের ঘরে। সকাল হলে একই মাঠে হাল-চাষ করে দুই সম্প্রদায়ের লোকজন। ধর্ম আর ভাষার ভিন্নতার কথা ভুলে বন্ধুত্বের মাত্রা ছাড়িয়ে আজীবনের বন্ধনেও জড়িয়েছে অনেকে।
এ গ্রামেই রয়েছে শত বছরের পুরানো বৌদ্ধ বিহার। সাবেক বিলছড়ি মহামনি ক্যাং বা বিহার নামেই এটি পরিচিত। বছরে প্রথম দিনে এই বিহারকে ঘিরে বৈশাখি মেলার আয়োজন হয়। বান্দরবান জেলা জুড়ে এই বিহারের খ্যাতি বেশ। তবে অন্য জেলার পূজারীরা এখানে বেশ ভিড় করেন বিশেষ দিনে। অনেকে আসেন মানত করে। মানুষের মুখে প্রচলিত কথা মতে “প্রায় ষাট বছর আগে বার্মার আইখ্যাপ, রেঙ্গুন থেকে নদী পথে নিয়ে আসা বড় বড় বুদ্ধমূর্তির অপরুপ নিদর্শন রয়েছে এই বিহারে” । লোকমুখে প্রচলন রয়েছে “অমাবশ্যা পূর্নিমা তিথিতে বিশাল আকৃতির তামার তৈরী বুড়া গোসাইর মূর্তিটিকে নদীতে নিয়ে স্নান করায় দেবদেবীরা। কারণ এই মূর্তির আধ্যাত্মিক শক্তি রয়েছে। এই মূর্তির সামনে বসে মনে মনে কেউ কোন কিছু কামনা করলে সুফল মেলে”।
একতলা বিল্ডিংএর কোটরিতে বড় বড় তিনটি বুদ্ধমূর্তি। মাঝ খানেরটা বেশ চিক্ চিক্ করছে। দেখতে বেশ চমৎকার। সবার শ্রদ্ধা উৎপন্ন হয়। হাজার হাজার পুজারি লাইন ধরে পূজা দিচ্ছে। কেউ মোমবাতি, কেউ বিভিন্ন ফুলমুল ও ফুল দিয়ে পূজা অর্চনা করছেন। বুদ্ধ প্রতিবিম্বের সামনে রাখা বিশাল আকারের ডোনেশন বক্সে অনেকে টাকা দান করছেন। দুই কক্ষের ভবনের পিছনের ভবনে রয়েছে নির্বাণশয্যা মূর্তি। মহামানব গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের মূর্তি তৈরী করে রাখা হয়েছে । নির্বাণ শয্যার পাশেই বুদ্ধকে প্রার্থনারত অবস্থায় রয়েছে বুদ্ধের পঞ্চবর্গীয়শিষ্যের মূর্তি।
একটু দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গেলে দেখামেলে সুউচ্চ বিশাল আকুতির জাদি। বার্মিজ ষ্টাইলে নির্মিত এই জাদির একপাশে খোলা মাঠ। ভিতরে ছোট পরিসরে বুদ্ধমূর্তি। পুজারিরা সেখানে পুজা করেন। পাশে গাছ দিয়ে তৈরীকরা টং ঘরে অনেকে বিশ্রাম নেন। বড় পরিসরে পাহাড়ি ভুমিতে এই বিহার নির্মান করা হয়েছে। পাহাড়ে নানা জাতের ফলের গাছ। জাদি থেকে দক্ষিন পূর্বে শেষ মাথায় গেলে দেখা মেলে বিশাল আকৃতির একটি বুদ্ধমূর্তি। এত বিশাল বুদ্ধমূর্তি দেখে পূজারী এবং দর্শনার্থীরা মুগ্ধ হয়ে উঠে। পাহাড়ের চুড়ায় দাঁড়িয়ে দেখা যায় মাতামুহুরী নদীর প্রবাহমানতা। সাপের মত পেচিয়ে চলে গেছে বঙ্গোপসাগরে।
পূজারীদের বিশ্বাস সাবেক বিলছড়ি ক্যাং বা বিহারে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা এই সংস্কৃতি, আচার, চর্চা লামা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বৌদ্ধজনগোষ্ঠীর কাছে পরম পুণ্যের। তাই বছরের প্রথম দিনে এক পলক দর্শন লাভের জন্য সাবেক বিলছড়ি মহামুনি ক্যাং বা বিহারে ছুটে আসেন। লামা উপজেলায় মারমা সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বড়ুয়া সম্প্রদায়্ও বাস করে। এ সম্প্রদায়ের লোক সংখ্যা কম হল্ওে বিশ হাজার। বিলছড়ি, দরদরী, হৃদয়মাষ্টার পাড়া, গগন মাস্টার পাড়া, রাজবাড়ীতে বসবাসরত বড়ুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান এই বিহার। এ বিহারে অন্তত বছরে একবার ছুটে আসার চেষ্টা করেন মানিকপুর, চকরিয়া, রামু উখিয়া কক্সবাজার অঞ্চলের পুজারিরা।
পার্বত্যবাসির কাছে প্রহেলা বৈশাখ খুব আনন্দের। এ উপলক্ষে পার্বত্য এলাকায় নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। বান্দরবান জেলায় বসবাসরত ১১ টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্টির মধ্যে মারামারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। মায়ানমারের সাথে তাদের কৃষ্টি কালাচার, আচার এবং পোষাক আষাকের সামঞ্জস্যতা বেশ। কালের বিবর্তনে সেটি নিজস্ব সংস্কৃতিতে রুপ নিয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় সাবেক বিলছড়ি বিহারে শুরু হয় সাংগ্রাই মেলার। কালের ধারায় বাঙালি সংস্কৃতির প্রসারের ধারাবাহিতকায় সেটি এখন বৈশাখি মেলায় রুপ নিয়েছে। মেলা হয়ে উঠেছে সার্বজনীন। পাহাড়ী বাঙালিদের মিলনমেলায় রুপ নিয়েছে সাবেক বিলছড়ির বৈশাখি মেলা। বছর দশেক আগে মেলার শেষ দিন পানি খেলার আয়োজন হতো। সেই পানি খেলা এখন প্রতিটি মারমা পাড়ায় স্বতন্ত্রভাবে আয়োজন করা হয়। সেই আয়োজনে প্রধান অতিথি হয়ে আসে কোন জনপ্রতিনিধি অথবা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদধারী কোন ব্যক্তি।
পুরোনো বছরের দুঃখগ্লানি স্মৃতি মুছে ফেলে নববর্ষের সূচনালগ্নে আনন্দের আবাহনই মুখ্য হয়ে ওঠে মারমা-ম্রোদের নিস্তরঙ্গ জীবনে, মাত্র দিন তিনেকের প্রাণখোলা হাসির জন্য তাঁরা যেন প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকেন সারাবছর। মেলায় এসেই তারা ভুলে যান নিত্যদিনের জীবনসংগ্রামে তাঁদের ক্ষুধা, ব্যাধি আর অসহায়তার কথা!। বৈশাখের আগমনী বার্তা পেয়েই ম্রো সম্প্রদায়ের যুবকযুবতীরা প্রস্তুতি নেন সাবেক বিলছড়ির মেলায় আসার। পাড়ায় বুড়োবুড়িদের রেখে সপ্তাহের জন্য চলে আসেন মেলায়। দুর পাহাড় থেকে পায়ে দুই একদিন হেটে মাথায় রঙিন পাগড়ি বেঁধে তারা পৌছে যান । মাথায় হরেক রকমের ফুল। গলায় ৫৪৩ মডেলের টেপ রেকর্ডার। ম্রো ভাষায় গান বাজছে। কারো কারো হাতে বাঁশি। সেই বাঁশিতেও রয়েছে ভিন্নতা।
মারমাদের ঢোল, কাঁসা আর বাঁশির আওয়াজে মুখর মেলার প্রাঙ্গণ। মাঝে মাঝে এক ঝাঁক ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ ভেসে আসে মেলার অন্য প্রান্ত থেকে। এযেন এক ভিন্ন আবহ। সাবেক বিলছড়ি মহামুনি বৌদ্ধ বিহারকে ঘিরে প্রায় শত বছর ধরে জমে উঠে বৈশাখি মেলা। তবে ঠিক কখন কি ভাবে এই মেলা হয়ে উঠেছিল কেউ সঠিক ভাবে বলতে পারেন না। মেলার উত্তরপাশে প্রায় আধা কিলোমিটার দুরত্বে মুসলিম বসতি। তিন রাস্তার মোড়ে বিশাল আকৃতির বটগাছ। বৈশাখের খরা রোদে বটগাছের শীতল ছায়ায় জমায়েত বসে বিভিন্ন পাড়া থেকে বিহারে আসা পুজারীদের। তারা কাগজ দিয়ে তৈরী করে সাজিয়ে আনা পুতুল , পাখি, হাতি নিয়ে গোল করে বসে ঢোল বাজায়। মারমা যুবতীরা বড় পাত্রের মধ্যে ডাব বা নারকেল, কলা , চাল, মোমবাতি, ধুপকাঠি ও রঙিন কাগজের ফুল সাজিয়ে মাথায় নিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে হেঁটে চলে বিহারে দিকে। পিছনে পিছনে পুতুল গুলোর খোলসে মানুষ প্রবেশ করে নাড়াচাড়া করে আগত দর্শনার্থিদের আনন্দদেয়। সেই সাথে ঢোলের তালে নাচে সবাই।
সাবেক বিলছড়ি বিহারের প্রবেশমূখে পুকুর। পিছনে স্কুল। পাশে একটি মাঠ। মাঠের এক কোনায় বোধিবৃক্ষ। অর্ধশতবষী। পুজারীরা বোধী বৃক্ষের গোড়ায় পানি ঢালে। তবে বৈশাখের মেলা বসে বোধী গাছের সাথেই লাগোয়া মাঠে। পাহাড়ীদের মেলা হিসাবে প্রচলন হলেও মেলায় অস্থায়ী সকল দোকানদার হিন্দু, মুসলিম সম্প্রদায়ের। পাহাড়ি বাঙালীর পারস্পরিক মেলবন্ধন দেখে বুঝার অবকাশ নেই তাদের ভাষা ধর্মবর্ণ ভিন্ন। বাঙ্গী, তরমুজ, জিলাপী, শুটকী মাছ, দই চিড়া, মুন্ডি পিঠা, নানা রঙের শরবত, খেলনা গাড়ি, কসমেটিকস সহ হরেক পদের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানীরা। শিশুরা বাঁশি, ডোল, ঝুনঝুনি নিয়ে মেতে উঠে। বাবা মায়ের কাছে বায়না ধরে প্লাষ্টিকের রঙিন চশমার।
সূর্য পশ্চিমে গেলেই মেলা থেকে রওনা হয়ে যায় বাড়ির দিকে। নানা জায়গার আগত মেহমান দের নিয়ে বাড়ি ফেরে। চলে ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায় আনন্দ। জমজমাট আড্ডায় জমে উঠে বাড়ি ঘরের উঠোন। মাঠ পেরিয়ে বাউন্ডারি ওয়ালে ঘেরা বিশাল পরিসরে পুরাতন বিহার। নানা কারুকর্যে খচিত। ভিতরে মহামতি গৌতম বুদ্ধের জন্ম থেকে মহাপরিনির্বান পর্যন্ত বিভিন্ন চিত্র তেল রঙে চিত্রায়িত করা হয়েছে। পুজারিরা মোমাতি জ্বালিয়ে তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সেই বেদিতে।
বিকাল হলেই একএকটি মারমা পাড়ার যুবক যুবতীরা সারিবদ্ধ ভাবে নেচে গেয়ে বিহার পদক্ষিন করে। নেতৃত্ব দেয় পাড়ার প্রধান। ম্রো সম্প্রদায় বৈশাখের প্রথমদিনেই তাদের ঐতিহ্যবাহী বাঁশি ও নাচের মাধ্যমে প্রদক্ষিন করে বিহার। বছর ঘুরে বৈশাখ আসে। বসে মেলা। মানুষের ব্যস্ততার কারনে সাত দিনের মেলার পরিসর ছোট হয়ে এখন তিন দিনে রুপ নিয়েছে। লামা উপজেলা ও এর আশাপাশের মানুষ অপেক্ষায় থাকে সাবেক বিলছড়ির আত্মীয় সম্মেলন ও সম্প্রীতির মিলনমেলার। শতবছরের এই ধারাবাহিকতা এখন ঐতিহ্য রক্ষা করে ইতিহাসে পরিণত হয়েছে।